জমির দলিল একজনের নামে আর রেকর্ড আরেকজনের নামে এই সমস্যাটি প্রায়ই শোনা যায় এবং বাস্তবেও দেখা যায়। এখন জমির দলিল একজনের নামে আর রেকর্ড আরেকজনের নামে হলে কি করণীয় তা নিয়েই আজকে মূল আলোচনা।
আর এই আলোচনার সাথে আমরা আরও জানতে পারবো যে, জমির দলিল কি, নামজারী কি, রেকর্ড কী ও এ পর্যন্ত কয়টি রেকর্ড হয়েছে, জমির দলিল একজনের নামে আর রেকর্ড আরেকজনের নামে হলে রেকর্ড সংশোধনের জন্য কোথায়, কিভাবে মামলা করবো, কি কি কাগজপত্র লাগবে এবং কত সময় লাগবে।
জমির দলিল কি
জমি বিক্রয় করার সময় একজন বিক্রেতা ( দাতা ) যখন একজন জমি ক্রেতা ( গ্রহীতা ) বরাবর সরকারের নির্দিষ্ঠ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে যে লিখিত চুক্তিনামা সম্পাদন করে তাকেই মূলত জমির দলিল বলে।
নামজারী কি
জমির দলিল একজনের নামে আর রেকর্ড আরেকজনের নামে কি করতে হবে তার আগে একটি বিষয় হলো জমির দলিল সম্পাদন করার পর যখন উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার-এর অফিস হতে নির্দিষ্ট উপায়ে একটি নিবন্ধন নাম্বারের মাধ্যমে নিবন্ধন করার পর একটি নির্দিষ্ঠ সময়ের পর জমির দলিল হাতে পাওয়া যায়।
জমির হাতে পাওয়ার পর জমির বর্তমান মালিক চাহিদাসম্পন্ন সকল কাগজ পত্র নিয়ে উপজেলা সহকারী ভূমি কমিশনার ( AC Land ) বরাবর আবেদন করে নিজের নামে করে নেওয়াকেই নামজারী বলা হয়।
নামজারী করার জন্য আপনি এই লিংকে গিয়ে আবেদন করতে পারবেন।
রেকর্ড কী ও এ পর্যন্ত কয়টি রেকর্ড হয়েছে
সরকার কর্তৃক তার অধিনস্থ ভূখণ্ডে জমির মালিকদের বাস্তবিক রূপ যেমন সরেজমিনে গিয়ে মালিকের জমির পরিমাণ, অবস্থান নির্ণয়ের জন্য যে কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে এবং লিপিবদ্ধ করা হয় তাকেই জমির রেকর্ড বলে।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৭টি জরীপ পরিচালিত হয়েছে।
- ১. Cadastral Survey বা CS -১৮৮৮-১৯৪০ সাল
- ২. State Acquisition বা SA -১৯৫৬ সাল
- ৩. Paskistan Survey বা PS – ১৯৫৬-১৯৬২ সাল
- ৪. Revisional Survery বা RS
- ৫. Bangladesh Survey বা BS- ১৯৯০ সাল
- ৬. City Servey বা সিটি জরীপ – ১৯৯৯-২০০০ সাল
- ৭. দিয়ারা জরিপ
- ৮. Bangladesh Digital Survey বা BDS ( বর্তমান চলমান )
জন্মনিবন্ধ চেক বা যাচাই কিভাবে করতে হয় তা জানতে এখানে ক্লিক করুন।
জমির রেকর্ডের উদ্দেশ্য কি
জমির দলিল একজনের নামে আর রেকর্ড আরেকজনের নামে এর সংশোধনের উপায় জানার আগে জানতে কেন জমির রেকর্ড কেন করা হয়। তার পেছনে কিছু কারণ আছে।
১. জমির দখলদারের কাছ থেকে জমির খাজনা আদায় করার জন্য।
২. জমির প্রকৃত মালিকদের নামে প্রতিটি আলাদা আলাদা খতিয়ান প্রস্তুত করা।
৩. জমির প্রকৃত মালিকদের নামে প্রতিটি জমির খন্ডের আলাদা আলাদা দাগ নম্বর দেওয়া এবং তা থেকে মৌজা ম্যাপ তৈরি করা।
যদিও প্রথম দিকে রেকর্ডের প্রধান উদেশ্য ছিল মধ্যস্বত্ব লোপ করে সরকার জমির মালিকদের কাজ থেকে খাজনা আদায় করা।
নিজের নামে নিজের জমির রেকর্ড না থাকার কারণঃ
১. যখন সরকার নির্ধারিত সময়ে স্ট্যাট একুজেশন বা এস এ রেকর্ড হয়েছিল তখনকার সময়ে আপনি উপস্থিত হতে পারেননি বা থাকতে পারেননি। সেই সময়ে সেখানে উপস্থিত অসাধু ব্যক্তি জরীপের কাজে থাকা সরকারি ব্যাক্তিদের ভুল বুঝিয়ে বা তাদের সাথে মিলে নিজের নামে রেকর্ড করে নিয়েছে।
অথবা জরীপকারী দল বা ব্যাক্তি তাড়াহুড়ো করে নিজের অর্পিত দায়িত্ব শেষ করতে ভুল করে অন্যের নামে রেকর্ড করে নিয়েছে।
আবার এমনও হয়েছে যে, জমির মালিককে না পেয়ে জরীপকারী ব্যাক্তি পূর্বের মালিকের নামেই রেকর্ড করে এন্ট্রি করে নিয়েছে।
২. দ্বিতীয় যে কারণ সেটি হলো আপনি যখন জমি ক্রয় করেছিলেন সে সময় মনে হয় SA বা BRS হওয়ার পর। যেহেতু আপনি জমি ক্রয় করার পর আর কোনো জরীপ কার্য সম্পাদন হয়নি তাই আপানার নামে কোন ধরনের রেকর্ড থাকবে না এটাই স্বাভাবিক।
তাহলে আপনি রেকর্ড নিয়ে খুবই চিন্তিত তাই না?
এক্ষেত্রে আপনার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ হলো, যেহেতু জমি দাতা জমি বিক্রয়ের পূর্বেই সকল চাহিদা সম্পন্ন কাগজ পত্র হালফিল করে দিবে তখন আপনার কাজ হলো সেখান থেকে একটি সেট নকল সংগ্রহ করে রাখা।
জমি ক্রয়ের পর আপনি যথাযথ নিয়ম মেনে নামজারি করে নিবেন। সেটাই আপনার জন্য হবে রেকর্ড।
তবে একটি কথা মনে রাখবেন যে, জমির দলিল একজনের নামে আর রেকর্ড আরেকজনের নামে তাহলে ভবিষ্যতে যখনই জরীপ কার্য পরিচালিত হবে আপনার হাতে যেন সঠিক কাগজপত্র থাকে এবং সঠিক সময়ে যাতে সাবমিট করতে পারেন।
জমির দলিল একজনের নামে আর রেকর্ড আরেকজনের নামে তাহলে কি কি করতে হবে?
যদি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে যেকোনো ভাবেই হোক না কেন যদি আপনার জমির দলিল থাকে এবং প্রকৃত মালিক যদি আপনি হয়ে থাকেন আর আপনার জমির রেকর্ড অন্য কারো নামে থেকে থাকে তাহলে রেকর্ড খতিয়ান সংশোধন করা আপনার জন্য বাধ্যতামূলক।
তাই এখন জানবো কোথায়, কিভাবে মামলা করবো,
কি কি কাগজপত্র লাগবে এবং কত সময় লাগবে।
জমির রেকর্ড সংশোধনের জন্য দুইটি পর্যায়ে করা হয়ে থাকে।
১. রেকর্ড খতিয়ান প্রিন্ট হওয়ার আগে।
২. রেকর্ড খতিয়ান প্রিন্ট হওয়ার পর।
রেকর্ড খতিয়ান প্রিন্ট হওয়ার আগেঃ
যদি আপনার রেকর্ড খতিয়ান প্রিন্ট হওয়ার আগে ভুল ধরা পরে তাহলে স্যাটলম্যান্ট অফিসার বরাবর আবেদন করতে হবে। তাহলে নিযুক্ত অফিসার আপনার আবেদনের বিষয়টি বিচার করে দেখবে যদি সঠিক তথ্য থাকে তাহলে সংশোধন করে দিতে পারবে।
তবে যদি প্রিন্ট হয়ে যায় তাহলে আর এই জায়গায় সংশোধনের সুযোগ থাকে না। তবে সংশোধন করার সুযোগ যে একেবারে থাকেনা তা না।
তবে এক্ষেত্রে সীমিত কিছু ক্ষেত্র আছে তা পারেন। যেমনঃ করণিক ভুল। এছাড়া যদি অন্য কোনো ভুল ধরা পরে তা আদালতের উপর ন্যস্ত থাকবে। যদি আদালত যদি আদেশ জারি করে তারপর স্যাটলম্যান্ট অফিসার যুক্তিযুক্ত মনে হলে করে দিবে।
রেকর্ড খতিয়ান প্রিন্ট হওয়ার পরঃ
যদি স্যাটেলম্যান্ট অফিসার-এর কার্যক্ষমতার মধ্য না থাকে তাহলে আপনাকে উনি বলে দিবে যে উনার দ্বারা সংশোধন কর্যক্রম করা সম্ভব না।
তাহলে আপনাকে ঐ সকল কাগজপত্র নিয়ে দেওয়ানী আদালত বা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবুন্যাল-এ গিয়ে ( যদি খোলা থাকে ) তাহলে আপনাকে ঘোষণামূলক মামলা করতে হবে। তাহলে আপনি প্রতিকার পেতে পারেন।
রেকর্ড সংশোধনী মামলার জন্য কি কি কাগজপত্র লাগবেঃ
জমির রেকর্ড সংশোধনী মামলার জন্য যে ঘোষণামূলক মামলা আপনি করবেন তাহলে যে কাগজগুলো আপনার লাগবে সেগুলো হলো।
১. আপনার উক্ত জমির মূল দলিলের ফটোকপি।
২. আপনার ক্রয়কৃত জমির পূর্বের মালিকের দলিল বা বায়া দলিলের ফটোকপি।
৩. আপনার ক্রয়কৃত এবং মালাকানাধীন জমির যত খতিয়ান আছে সেগুলোর ফটোকপি।
৪. বর্তমান ভুল সম্বলিত খতিয়ান বা যেখতিয়ান আপনি সংশোধন করতে চাচ্ছেন সেটির ফটোকপি।
৫. আপনার জাতীয় পরিচয়পত্রের বা NID এর ফটোকপি।
উক্ত কাগজপত্র সংগ্রহ করে আপনি দেওয়ানী আদালতে মামলা করবেন। এক্ষেত্রে আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে যে, আপনি যে আইনজীবির কাছে যাবেন বা যাচ্ছেন সে যাতে অভিজ্ঞ হয়।
আপনি মামলা করার পর যদি আপনি সঠিক তথ্য দিয়ে থাকেন আর যদি বিচারক সঠিক মনে করেন তাহলে আপনার পক্ষে ডিক্রি জারী করবেন।
তারপর এই ডিক্রি নিয়ে স্যাটলম্যান্ট অফিসে গিয়ে জমা দিতে হবে। যদি নিযুক্ত কর্মকর্তা তথ্য সন্তোষজনক মনেকরে তাহলে রেকর্ডটি সংশোধন করে আপনার নামে সঠিক তথ্য দিয়ে আপনাকে প্রিন্ট করে দিয়ে দিবে।
জমির রেকর্ড সংশোধনী মামলা কত দিন লাগেঃ
জমির রেকর্ড সংশোধনী মামলা করার আগেই অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে যে কত লাগবে। কত দিনে এই মামলার রায় বা ডিক্রি পাব।
আমাদের দেশের আদালতের কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক সময় বেশ কিছু মামলার ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ হয়ে যায় এটা কিন্ত অপ্রিয় সত্য।
এর মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে যে, বিবাদীকে যখন মামলার নোটিশ পাঠানো হয় উনারা কৌশলে পরপর অনেকবার সময় নিয়ে থাকে আদালতে আসেনা। যার ফলে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা দেখা যায়।
তবে আপনি যদি নিয়মিত আদালতের সময় অনুযায়ী আদালতে হাজির হোন তাহলে আশাকরা যায় ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে এই ধরনের মামলা নিষ্পত্তি হয়ে থাকে।
পরিশেষে একটি কথা, জমি সংক্রান্ত কোন ঝামেলা থাকলে তা আপনি সংশোধনের চেষ্ঠা করুন দ্রুততা এবং সঠিকতার সাথে। তা না হলে কিন্ত এগুলোর বড় একটি প্রভাব আপনার পরবর্তী প্রজন্মের উপর বর্তাবে।